ভাষা নিয়ত পরিবর্তনশীল এবং ভাষার পরিবর্তন হয় এলাকাভিত্তিক এবং দুরম্নত্বের উপর নির্ভর করে।সে হিসেবে সিলেটিদের মুখের ভাষা প্রকৃত বাংলা ভাষা হতেবেশ খানিকটা দুরে। সিলেট ঐতিহাসিকভাবেই আলাদা ভাষা এবং আলাদা সংস্কৃতি ধারণ ও লালন করে আসছে। এখানে বিভিন্ন সম্প্রদায়ের বসবাস যার ফলে ভাষারক্ষেত্রেও রয়েছে বৈচিত্র্য । পূর্বে সিলেট আসাম রাজ্যের অন্তর্গত থাকার ফলে সিলেটের ভাষা ও সংস্কৃতিতে আসামের প্রভাব লক্ষ্য করা যায়। এছাড়াও সিলেটের রয়েছে এক বৈচিত্র্যময় নিজস্ব বর্ণমালা যা নাগরী লিপি হিসেবে পরিচিত।
সিলেটের স্বতন্ত্র সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের উজ্জ্বলতম দলিল নাগরী লিপি। এই রীতিতেই রচিত হয় তৎকালীন উন্নত সাহিত্য। সিলেটের আঞ্চলিক বা কথ্য ভাষার রয়েছে বিজ্ঞান সম্মত লিপি মালা। গবেষক ও ভাষা বিজ্ঞানীদের কাছে এটি রীতিমতো বিস্ময়কর। নাগরীর আরেকটি বৈশিষ্ট্য হচ্ছে-এটি সিলেট অঞ্চলের মুসলমানদের একান্ত নিজস্ব সম্পদ।
নাগরীর অক্ষর মাত্র ৩২টি। যুক্ত বর্ণ সাধারণত ব্যবহৃত হয় না। মাত্র আড়াই দিনেশেখা যায়। তাই মহিলাদের মধ্যে নাগরীর প্রচার ও প্রসার ছিল বেশি। এখনো অনেক মহিলা নাগরী জানেন।
নাগরীতে রচিত পুঁথি পুস্তকের বিষয়বস্ত্ত প্রধানত নামায,রোজা, হজ্ব, যাকাত, ইসলামী ইতিহাস, ঐতিহ্য, কাহিনী এবং রাগ, বাউল ও মরমী সঙ্গীত। এ পর্যন্ত ৮৮টি মুদ্রিত গ্রন্থসহ (নাগরী হরফে) ১৪০টি গ্রন্থের সন্ধান পাওয়াগেছে। ‘সিলেটী নাগরী লিপি ভাষা ও সাহিত্য’ সম্পর্কে গবেষণা করে জনাবগোলাম কাদির ১৯৮৩ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়থেকে পিএইচডি ডিগ্রী লাভ করেন।
নাগরী সাহিত্যে ছাদেক আলী সর্বাধিক জনপ্রিয় কবি। তিনি ১৭৯৮ সালে কুলাউড়ায় জন্মগ্রহণ করেন। ইসলাম ধর্ম গ্রহণের আগে তার নাম ছিলগৌর কিশোরসেন। ১৮২৩ সালে তিনি মৌলভীবাজারের মুনসেফ ছিলেন।
নাগরী পুঁথি রচয়িতাদের মধ্যে এ পর্যন্ত মুন্সী ইরপান আলী,দৈখুরা মুন্সী, আব্দুল ওহাবচৌধুরী, আমান উল্যা, ওয়াজি উল্যা, শাহ হরমুজ আলী, হাজী ইয়াছিনসহ ৫৬ জনের পরিচিতি পাওয়াগেছে।গোলাম হুসনের লিখিত ‘তালিব হুসন'কে প্রথম গ্রন্থ রম্নপে ধরে নেওয়া হয়।
ড: সুনীতি কুমার চট্টোপাধ্যায় খৃষ্টীয় চতুর্দশ শতাব্দীকে নাগরী লিপির প্রচলন কাল বলে মত প্রকাশ করেন। আবারকেউকেউ মনে করেনষোড়শ শতাব্দীরশেষ দিকে মোঘলদের দ্বারা তাড়িত হয়ে সিলেটে আগত আফগান পাঠানরা এর সৃষ্টি করেন। এ ব্যাপারে আরেকটি মত চালু রয়েছে।সেটি হল-ফোর্ট উইলিয়াম কলেজ সৃষ্ট সংস্কৃত বহুল বাংলার বিকল্প রম্নপে সিলেটীরা এই লিপি ও সাহিত্যের জন্মদেন।
নাগরী লিপিতে সাহিত্য সৃষ্টির অনেক পর এর মুদ্রণ শুরম্ন হয়। টাইপ ও ছাপা খানার অভাবে হাতে লিখেই নাগরীর প্রসার ঘটে। এ সময় সিলেট শহরের হাওয়াপাড়া নিবাসী মৌলভী আব্দুল করিম ইউরোপ সফরশেষেদেশেফেরেন। নাগরী লিপির টাইপ তৈরি করে চালু করেন ছাপা খানা। বন্দর বাজারে স্থাপিত ঐপ্রেসের নাম ছিল ইসলামিয়া প্রেস। মুক্তিযুদ্ধের সময় প্রেসটিবোমায় পুড়ে যায়। সিলেট শহরের নাইওরপুলে ছিল সারদা প্রিন্টিং পাবলিশিং। ১৯৪৭ পূর্ববর্তীকালে কলকাতা ও শিয়ালদহেও নাগরী লিপিরপ্রেস ছিল।
বৃহত্তর সিলেট, কাছাড়, করিমগঞ্জ, ময়মনসিংহ, কিশোরগঞ্জ প্রভৃতি এলাকায় নাগরী লিপি ও সাহিত্যের প্রচার ও সমাদর ছিল। বর্তমানে নাগরীর চর্চা কম হলেও তা একেবারে হারিয়ে যায়নি।
মণিপুরি নৃত্যকলা
মণিপুরি সংস্কৃতির সমৃদ্ধতম শাখা হলো নৃত্যকলা। মণিপুরি ধর্মমতে মানব ও পৃথিবী সৃষ্টির ঊষালগ্নথেকেই নৃত্যের শুরম্ন। কথিত আছে, সৃষ্টির আদিতে সমগ্র পৃথিবী ছিলো বিশাল জলরাশি। মণিপুরিদের আদিদেবতা আতিয়া গুরম্ন সিদাবা যখন পৃথিবীতে স্থলভূমি ও মানুষ সৃষ্টির পরিকল্পনা করলেন তখন তিনি প্রথমেই ৭ জনদেবতা ও ৭ জন দেবী সৃষ্টি করলেন। ৭ জনদেবী মনের অপার আনন্দে বিশাল জলরাশির উপর শুরম্ন করলেন আনন্দময় নৃত্য আর সেই নৃত্যের তালে তালে ৭ জন দেবতা স্বর্গথেকে নিক্ষেপ করতে থাকলেন মুঠো মুঠো মাটিরঢেলা, আর এভাবেই সৃষ্টি হলো বিশাল স্থলভূমি।
নৃত্যের মণিপুরি প্রতিশব্দ হলো-জাগোই। বিশেষজ্ঞদের মতে-চৎনা চৎনা কোয়বা-হেঁটেহেঁটে বৃত্ত সৃষ্টি করাথেকে চকোয় যা পরিবর্তিত হয়ে জগোই শব্দের উৎপত্তি ঘটিয়েছে। আবার অনেকের মতে, এই জাগোই শব্দের উৎপত্তি সংস্কৃত চক্র শব্দথেকে। আর তাই মণিপুরি নৃত্যের দৈহিক গতিই বৃত্ত বা অর্ধবৃত্ত রচনা করে যাগোলাকৃতির মণিপুর উপত্যকা বা বৃহত্তর অর্থে পৃথিবী ও বিশ্বসৃষ্টির প্রতীক।যে কারণে মণিপুরি নৃত্য এতো জীবনঘনিষ্ঠ।
মণিপুরি নৃত্যের আদিরূপ লাই হারাওবা নৃত্য। লাই অর্থদেবতা, হারাওবা অর্থ আনন্দ। অর্থাৎদেবতাদের আনন্দ বিধদানের জন্য নৃত্য পরিবেশনা। বর্তমানে প্রচলিত লাই হারাওবা নৃত্যে চারটি প্রকারভেদ রয়েছে। এগুলো হলো কংলৈ হারাওবা, মোইরাং হারাওবা, চকপা হারাওবা ও ককচিং হারাওবা । লাই ঈকৌবা বাদেবতার উদ্ধোধন দিয়ে শুরম্ন লাই হারাওবা নৃত্য। তারপর পর্যায়ক্রমেপরিবেশিত হতে থাকে লৈশেম জগোই (পৃথিবী সৃষ্টির নৃত্য), লৈনেৎ জগোই (সমতল ভূমি সৃষ্টির নৃত্য), লৈতা জগোই (বসতি স্থাপনের নৃত্য), লৈমা জাগোই (কুমারী নৃত্য)। তারপর ধীরে ধীরে গৃহনির্মাণ, কাপড়বোনা, শস্যরোপন, শিকার, বিভিন্ন ক্রীড়াকৌশল, সমস্ত কিছুই পর্যায়ক্রমে পরিবেশিত হতে থাকে। তাই ঐতিহাসিক Saraj Nalini Parrottবলেছেন, The Lai Haroba mirrors the entire culture of the Manipuri People. লাই হারাওবা নৃত্য যদিওলোকনৃত্য তবু ধ্রুপদী নৃত্যের শৃংখলা এতে সুষ্পষ্ট। বসত্মুতঃ এই নৃত্যেই ধ্রুপদী নৃত্যের অংকুর বিশেষ। এই নৃত্যে নানা প্রকারলৌকিক হস্তমুদ্রাব্যবহ্নত হয়। তান্ত্র্রিক হস্তমুদ্রার সাথে সাদৃশ্য লক্ষণীয়। পরবর্তীকালে লাই হারাওবা নৃত্যই পরিশোধিত-পরিমার্জিত হয়ে রূপ নিয়েছে ধ্রুপদী নৃত্যের। মণিপুরে বৈষ্ণব সংস্কৃতির প্রসারের পরথেকে এই নৃত্যে রাসনৃত্যের অন্যতম উপাদান ভঙ্গি পারেং-এর প্রভাব পরিলক্ষিত হয়।
ছবি
Planning and Implementation: Cabinet Division, A2I, BCC, DoICT and BASIS